HT Bangla Special:দুর্গাপুজোর সময় বড় রাস্তার মোড়গুলোতে যেমন দড়ি বাঁধা থাকে, তেমন দড়ি লাগে কলকাতা বইমেলায়। খুলতেই পিলপিল করে লোক ছুটে চলেছে। এপার থেকে ওপার। কীসের জন্য? দুই মলাটের ভিতরে থাকা পাতার টানে? নাকি পরিচিত মানুষ, সেলেব্রিটি লেখক, খাবার, বই হাতে নিয়ে ছবি আর নিজেকে ‘সংস্কৃতিমনস্ক’ প্রমাণের অদম্য দায়? মাঝে মাঝেই তর্কের ঝড় ওঠে— ‘এখন কি লোকে বই পড়ে?’ বইমেলার বুকেই অডিটোরিয়ামে এমন সভার আয়োজন হয়। গত বছরও হয়েছিল, এই বছরও হয়েছে। যোগ দিয়েছেন বাঘা বাঘা সাহিত্যিক ও তার্কিকেরা। বই পড়ে ও পড়ে না — দুই পক্ষেই প্রচুর ভোট থাকে। হয়তো শেষ পর্যন্ত জিতে যায় ‘লোকে বই পড়া কমিয়ে দিয়েছে’ — তত্ত্বটাই। কিন্তু যাঁরা বই পড়ছেন, তাঁদের কাছে এই অভ্যাস কেমন? পাঠক না হলেও শিক্ষাব্যবস্থার সুবাদে অনেকেই শৈশবে বইয়ের সঙ্গে ঘর করেছেন। মেলায় আসা ক্রেতা (বা পাঠক বা বই-দর্শক)-দের পাশাপাশি শোনা গেল তেমনই কিছু মানুষের বই পড়ার অভিজ্ঞতা।
‘ঘুম আনতে যেটুকু পড়া’
কলকাতা বইমেলায় ডিউটি পড়েছে বিধাননগর থানার সাব ইন্সপেক্টর বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের। পঞ্চাশোর্ধ্ব বিশ্বজিৎ বসেছিলেন পুলিশের স্টলে। স্টল ঘুরতে ঘুরতেই প্রশ্নবাণ — ‘বাড়িতে বই পড়া হয়?’ ‘একদম। তবে ঘুম আনতে যেটুকু পড়া। শরৎ রচনাবলী, বঙ্কিম রচনাবলী বেশি পড়ি।’ পছন্দের লেখক তবে কে? সময় না নিয়েই বললেন, ‘শঙ্কর। অফিস এনভারমেন্ট নিয়ে ওঁর লেখা বিভিন্ন উপন্যাস দারুণ লাগে।’ চৌরঙ্গি উপন্যাসটা নাকি সবচেয়ে বেশি পছন্দ!

‘বই কিনতে ছেলেকে নিয়ে আসব’
দুপুর নাগাদ খাবারের স্টলের দিকে ভিড় বেশি। স্বাভাবিক। বইয়ের স্টলের দিকে আসতে আসতে পিছন থেকে দুই মহিলা পুলিশের কথোপকথন শোনা গেল। ‘কাল সারারাত ঘুম হয়নি…’ কথা বলতে জানা গেল বইমেলা তার কারণ নয়। বই পড়ার অভ্যাস আছে? বিধাননগর উমেন পিএস-র কনস্টেবল শ্রাবণী জ্যোতি প্রশ্ন শুনতেই ঘাড় নব্বই ডিগ্রি হেলিয়ে দিলেন। ‘বই কেনা হল কিছু?’ বললেন, ‘শেষ দিন কিনব। ওই দিন ছেলেকে নিয়ে আসব।’ কোন ধরনের বই পড়তে বেশি ভালো লাগে? ‘কমিকস। যে কোনও ধরনের!’

‘বই কেনার পয়সা কই?’
বইমেলা যেতে বিধাননগর থেকে বাস ধরতে হবে। মেলার সময় কিছু বাস বুদ্ধি করে সামনের কাঁচে ‘বইমেলা’ লেখা কাগজ সেঁটে দেয়। তেমন একটা কাগজ সাঁটা বাসে উঠে পড়া গেল। কন্ডাক্টর সামান্য বয়স্ক। ভাড়া দিতে দিতে দুপুরের ফাঁকা বাসে গল্প জমে উঠল। বইমেলার প্যাসেঞ্জার কেমন হয়? ‘ওরে বাবা, রোববার গাদা গাদা প্যাসেঞ্জার। বিকেলের দিকে এস্পেশালি।’ এত প্যাসেঞ্জার নিয়ে যাও, নিজে কখনও গিয়েছ? ‘একবার গেছি। দু'বছর আগে বাচ্চা ছেলেটা বায়না ধরেছিল। তাছাড়া, বই কেনার পয়সা কই? মেদিনীপুর থাকতে লাইবিরির বই পড়েছি। বই কিনতে লাগত না। তারপর তো পড়া ছেড়ে কনডাকটারি…’

বইমেলায় অনেকেই নাকি শুধু খেতে…
নিন্দুকরা বলেন, বইমেলাতে অনেকেই নাকি শুধু খেতে যান। বই দেখতে ও কিনতে যান গুটিকয়েক। ফিশ ফ্রাই, চাউমিন বিক্রি করছেন এক খাবারের দোকানদার। খাবার সার্ভ করতে করতেই বললেন, ‘এই ক’দিন দারুণ সেল হয় দাদা। শনি-রোববার দম ফেলার সময় থাকে না। স্টল ভাড়া আরামসে উঠে যায়!’ শুধু খাবার বেচা হয় নাকি মাঝে মধ্যে বইয়ের স্টলেও ঢুঁ মারেন? এক কমবয়সি দোকানদারের কথায়, ‘আমার বই পড়ার সময় কই! বউ একটুআধটু পড়তে ভালোবাসে। ওকে একদিন নিয়ে আসি মেলায়। ওইদিন দোকানে লেবার রেখে একটু ঘুরে আসি মেলাটা।’

‘অনেক দুষ্প্রাপ্য বই পাওয়া যায়’
আগের তুলনায় এখন নাকি বই পড়া সত্যিই কমে গিয়েছে। নানা বিতর্ক সভায় এই কথাটা তার্কিকরা স্বীকার করেন। একেই বই কম পড়া হয়, তার উপর ছাড় কম। এই অবস্থায় অনেকের থিওরি, ‘বইমেলায় বই দেখে পছন্দ হলে কলেজ স্ট্রিট থেকে কেনা উচিত। ওখানে ডবল ছাড় পাওয়া যায়!’ কিন্তু তরুণ পাঠক শৌভিক জানাচ্ছেন, ‘বইমেলায় এমন অনেক অজানা দুষ্প্রাপ্য বই পাওয়া যায়, যা কলেজ স্ট্রিটে পাওয়া যায় না। ওগুলোর জন্যই তো আসা। অনেকে এগুলোর খোঁজ রাখেন না!’
‘যাদের বই পড়ার, তাঁরা ঠিকই পড়বেন’
সম্প্রতি বইমেলার এক অনুষ্ঠানে গিল্ড সভাপতি ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, বই পড়া সত্যিই কমে যাচ্ছে। কারণ জনসংখ্যা আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু বই পড়া বা বিক্রি সেই হারে বাড়েনি। শিলিগুড়ি থেকে আসা পায়েলের মত এই ব্যাপারে মিশ্র। ‘বই পড়ার হার হয়তো সত্যিই কমেছে। কিন্তু বই বিক্রি দিয়ে সেই হার বিচার করা মুশকিল। একশোটা বই কিনে একজন দশটা বই পড়লে সে বেশি বই পড়ল না পঞ্চাশটা বই কিনে একজন কুড়িটা বই পড়লে, সে বেশি বই পড়ল?’ বই পড়া বা না পড়া নিয়ে এই বিতর্ক বরাবরই ছিল। অধ্যাপিকা সুদর্শনার বিশ্বাস, ‘যত যুগ বদলাবে, প্রযুক্তি মানুষের সময় দখল করবে, তত এই বিতর্ক বাড়বেই। কিন্তু শেষমেশ যাদের বই পড়ার, তাঁরা ঠিকই পড়বেন। এতরকম মিডিয়াম থাকতেও যারা বই ভালোবাসেন, তাঁরা বইকে সঙ্গী করেই রাখবেন। তাঁদের জন্যই তো এত আয়োজন!’

ভালোবাসার সমীকরণ
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মাধ্যম পুঁথি, যার আধুনিক সংস্করণ বই। বই তো শুধু বই নয়, লেখালেখির চিরাচরিত মাধ্যমও। ডিজিটাল পাতায় সাহিত্যরচনা তো হাল আমলের। ছবির পরেই বোধহয় এসেছিল লেখালেখির এই মাধ্যম। মানুষ প্রজাতির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বেড়ে উঠেছে। হাজার হাজার বছর ধরে। আজ কি অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে গিয়ে তার হাঁফ উঠছে? টিভি, ওটিটি, রিল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, কম্পিউটার, অফিস, এআই —ভিড় অনেক। নেহাতই অফিসটাইমের বাসে ওঠা হাজার একটা সহযাত্রী মাধ্যমের ভিড়ে চিড়েচ্যাপটা হয়ে যাচ্ছে বই? গন্তব্যে চলতে চলতে ঘেমেনেয়ে বিধ্বস্ত হচ্ছে? ঘাম তো ঝরছেই। বইমেলার ফ্লাড লাইটে, বসন্তের গোড়ায় হঠাৎ শীত গা ঢাকা দিয়ে পালানোয় হাজার হাজার পাঠক ঘামছেন। শুধু বই ভালোবেসে। বইও তাই ঘামছে পাঠকের জন্য! এই ভালোবাসা যদ্দিন থাকবে, তদ্দিন হাজার মাধ্যম এলেও পাঠকরা ঘাম ঝরাবেন। শুধু বইয়ের জন্য। আর ভালোবাসার সমীকরণ এভাবেই হয়তো প্রযুক্তিকে ঠেকিয়ে বই-তর্ক জিইয়ে রাখবে, না-মেলা হিসেব মিলিয়ে দেবে!
(সব ছবি - সংকেত ধর@HT বাংলা ও বইমেলা অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ)