প্রাণের গান, মাটির গান আঁকড়েই আজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন ‘ঝুমুরিয়া’ সুভাষ চক্রবর্তী। ব্রাত্যজনের সংগীত ঝুমুরকে অনাথ করে চলে গেলেন বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের এই লোকগান শিল্পী। শনিবার ১১.৫৫ নাগাদ কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সুভাষ চক্রবর্তী। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলাকে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন পুত্র অপর্ণ চক্রবর্তী।
অর্পণ জানান, লিভার সিরোসিসের সমস্যায় ভুগছিলেন শিল্পী। ক্য়ানসারের একদম শেষ পর্যায়ে ছিলেন। শুরুতে অ্যাপোলো, এবং পরবর্তীতে পিয়ারলেস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। গত কয়েকদিন ধরেই ভেন্টিলেশন সাপোর্টে ছিলেন ‘মরক পরবে’র স্রষ্টা। তবে শেষ রক্ষা হল না।
১৯৫২ সালে বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে জন্ম এই ঝুমুর শিল্পীর। ছোট থেকেই সঙ্গীতের পরিবেশেই বড় হয়ে ওঠা। সত্তরের দশকে লোকগানের দুনিয়ার উঠতি শিল্পী ছিলেন সুভাষ বাবু। সেইসময় অরুণ কুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে আলাপ ঝুমুর গানের এক আড্ডায়। তাঁর লেখা ‘শ্রীরাম ইস্টিশনের মহুয়া গাছটা’ কবিতায় সুরারোপ করেন সুভাষবাবু, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয় ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা…’ নামে। এই বহুল প্রচলিত লোকগানের নেপথ্যের শিল্পীরা আজীবন থেকে গিয়েছেন প্রচারের আড়ালেই। লাল মাটির দেশ ছেড়ে কোনওদিনই কলকাতায় এসে সঙ্গীতের জগতে নিজের পরিচিত গড়ার চেষ্টা করেননি সুভাষ চক্রবর্তী, আক্ষেপের সুরে জানিয়েছিল তাঁর সুযোগ্যা কন্যা অর্পিতা চক্রবর্তী। প্রচারবিমুখ হওয়ার জেরেই ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা',‘মরক পরবে’-র মতো গানগুলো জনপ্রিয়তা পেলেও খানিক অন্তরালেই থেকে গিয়েছেন সুভাষবাবু।
লোকগান ছিল সুভাষ চক্রবর্তীর প্রাণ। তিনি বলতেন, ‘লোকসঙ্গীত শিকড়ের গান। শেকড়কে বাদ গিয়ে হাঁটা যায় না। একটা বৃক্ষ যেমন শেকড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, গোটা সংস্কৃতিটাই লোকসঙ্গীতের উপর দাঁড়িয়ে। ঝুমুর, ভাদু, টুুসু আমার রক্তে…’।
সুভাষ চক্রবর্তীর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী জানান, ‘…সুভাষবাবু ঐতিহ্যময় লোকসংগীতকে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট কিছু অবিস্মরণীয় লোকগান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।তাঁর প্রয়াণে সংগীত জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল। আমি সুভাষ চক্রবর্তীর পরিবার-পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি’।
বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করে সুভাষ চক্রবর্তীর দুই সন্তানই লোকগানকেই বেছে নিয়েছেন। সারেগামাপা-র মঞ্চে প্রসংশা কুড়িয়েছেন সুভাষ কন্যা অর্পিতা। ছেলে অর্পণও বাংলা গানের জগতের পরিচিত নাম। অপর্ণ জানান,'আমার কাছে এটা ব্যক্তিগত ক্ষতি তো বটেই, তবে লোকসঙ্গীত নিয়ে যারা কাজ করে তাঁদের সবার জন্য এটা বড় ক্ষতি'। আজ (শনিবার) বিকালে রবীন্দ্রসদনে শায়িত থাকবে তাঁর দেহ, এরপর সেখান থেকে বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে সুভাষ বাবুর মরদেহ। রবিবার কলকাতার কেওড়াতলা মহশ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
সুভাষ চক্রবর্তীর প্রয়াণে শোকের ছায়া লোকগানের জগতে। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে লোকসঙ্গীতের একটি ঘরানা হারিয়ে গেল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷